শিশুর যত্ন কিভাবে করবেন ? শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষার উপায়, মানব শিশুরা যারা সদ্যই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছে, তাদের মধ্যে যারা রুগ্ন বা স্বাস্থ্যহীন তাদের সুস্থ রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা উচিত। শিশুপালন ও শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়ে প্রত্যেক ব্যাক্তির ওয়াকিবহাল থাকা দরকার।
শিশুর যত্ন, জন্মাবার পর করণীয়:
- শিশুর জন্ম হওয়ার পরে তার স্বাস্থ্যরক্ষার ভার পড়ে দিদিমা ও ঠাকুরমার উপর। জন্মের পরে শরীর পরিষ্কার করা ও নাভিচ্ছেদন প্রথম কর্তব্য তা নার্স ও ধাই-এরা করে থাকেন।
- সাধারণ গ্রাম অঞ্চলে, দিদিমা, ঠাকুরমা, মাসীমা, পিসিমার হাতেও পরবর্তীকালে শিশুর লালনপালন ও স্বাস্থ্যরক্ষার ভার পড়ে।
- প্রসবান্তে মা শিশু সেবায় অক্ষমই থাকে, শিশুকে দুধ দেওয়াই তখন একমাত্র কাজ। তখন শিশুর সঙ্গে মায়েরও শুশ্রুষার ও স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যবস্থা অভিভাবকদের করতে হবে।
- দুই থেকে তিন মাস পরে মা শিশুর লালনপালনের ভার নিতে পারে। শিশুর জন্মদিনের সংস্কার অর্থাৎ শিশু যাতে স্বাস্থ্যবান, বুদ্ধিমান, বিদ্যাবান ও সুন্দর হয়ে পৃথিবীর সেবা করে ধন্য হতে পারে তার জন্য জন্মের দিন থেকেই তাকে সাহায্য করা উচিৎ।
প্রসব পরে শিশুর যত্ন:
- সদ্যোজাত শিশুকে কোলে তুলে নেবে অন্য কোন মহিলা, যার হাত পরিষ্কার, গাত্র স্বচ্ছ, অঙ্গুলির নখ কাটা ।
- সুস্থ শরীর ও মন, শিশুর প্রসবকালীন কষ্ট দূর করবার জন্য শিশুর গাত্রে সামান্য তৈল মর্দন করে, সমস্ত শরীরে অল্প অল্প শীতল (শীতকাল হলে উষ্ণ জল) জল দ্বারা ধুয়ে, পাতলা ও নরম কাপড়ে মুছিয়ে দিবে।
- পরে শীতকাল হলে গরম সুতীবস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত করতে হবে এবং গরম কাল হলে পাখা দ্বারা মৃদু হাওয়া করতে হবে।
- এইভাবে এর ঘণ্টা পরে তার মুখের তালু ঔষ্ঠ কণ্ঠ-জিহ্বা সচ্ছ তুলা দ্বারা পরিষ্কার করতে হবে। মুখ পরিষ্কার করে ৫ ফোটা ঘৃত ও দশ ফোটা মধু একত্রে মিশিয়ে অল্প মাত্রায় চামচ দিয়ে শিশুর মুখে। ২/১ ঘণ্টা অন্তর দিতে হবে। য
- খন শিশু মুখ খুলে জিহ্বা ওষ্ঠ চুষিতে থাকবে তখন মাতৃস্তন্য দিতে হবে। মাতৃস্তন্য পানে শিশুর নেশা হবে এবং নিদ্রিত হয়ে পড়িবে।
- শিশুকে শুষ্ক, পরিচ্ছন্ন, আলোক ও বায়ুযুক্ত বৃহৎ কামরায় রাখতে হবে। প্রসুতির শয়ন, আহার, নিদ্রা, পায়খানা ও প্রসাব করার ব্যবস্থা সুচারু রূপে করতে হবে।
- শিশুকে প্রসূতিগৃহেই ১মাস পর্যন্ত রাখতে হবে। পরে শিশুর পরিচর্যা ও স্বাস্থ্য রক্ষার ভার মায়ের উপর দিতে হবে।
১ মাস পর থেকে শিশুর যত্নঃ
- শিশুকে ঠিক সময়ে স্নান করানো , পরিমিত ও সময়মতো খাদ্য পানীয় প্রদান, গায়ে তেল মালিশ করা, পায়খানা ও প্রস্রাব পরিষ্কার করা, সবুজ ও হালকা বস্ত্র পরিধান করানো ইত্যাদির প্রতি মাতা ও ধাই লক্ষ্য রাখবে। কোন প্রকারে শরীর অসুস্থ হলে অভিভাবক বা চিকিৎসককে জানাতে হবে।
- শিশুকে আদর করে যেন অনেক লোকে কোলে না নেয়। তাতে তার শরীর খারাপ হবে। স্বভাব রুক্ষ হয়ে যাবে, একলা থাকতে চাইবে না।
- শিশুকে ৬মাস পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধের উপর রাখা যাবে। কিন্তু মাতৃদুগ্ধ পরিমাণ মত না হলে ছাগদুগ্ধ, গোদুগ্ধ অথবা ভেড়ীর দুগ্ধ জল মিশিয়ে মধুর সঙ্গে খাওয়ানো যেতে পাবে। দিনে একবার ২/৩ চামচ আঙ্গুর কিংবা বেদানার রস দিলে শরীর ভালো থাকবে।
- ছয় মাস পরে বেবীফুড দেওয়া যেতে পারে। গরম দুধে বেবীফুড মিশিয়ে দিলে ভাল হয়। শুধু বেবীফুড খেলে পরে শিশুর স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যায়।
- এক বৎসর পরে শিশুকে দুধ ভাত কিম্বা নিরামিষ তরকারী ভাত ১বার ও দুইবার দুধ দেওয়া যেতে পারে। পরে ২ বার ভাত ও একবার দুধ দিলেও শিশুর স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে। ১ বৎসর বয়স হবার পরে ভাতই শিশুর প্রধান খাদ্য হবে। দুধ ও ফলের রস সঙ্গে দিতে হবে।
- ডিম মাংস দিলে লিভারের ক্রিয়া খারাপ হয়ে যাবে। ২ বৎসরের পূর্বে আমিষ ভোজন হজমেরও আমাশয়ের পক্ষে ক্ষতিকারক।
- শিশুকে অকারণে ঔষধ খাওয়ানো উচিত নয় এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অন্য ঔষধ দেওয়া উচিত নয়। দুগ্ধপায়ী শিশুর মায়ের স্বাস্থ্য ভাল থাকা শিশুর স্বাস্থ্যের পক্ষে উপযোগী।
- এইজন্য মাকে সাধারণত সর্বপ্রকার স্বাস্থ্যনীতি পালন করে চলিতে হবে। তা না হলে শিশুর যত্ন নিলেও মায়ের দুগ্ধপান করে শিশু রুগ্ন হয়ে পড়বে।
- শিশুর গায়ে তেল মালিস করার সময় তেলের সঙ্গে হলদির রস, নিমপাতার রস অথবা ত্রিফলার চূর্ণ ও তিলের খইল বাটা মাখিয়ে নিলে শরীর কোমল, উজ্জ্বল ও সুন্দর হবে। মাঝে মাঝে ব্রাহ্মী শাকের রস মধু দিয়ে খাওয়ালে শিশুর স্মৃতিশক্তি
- প্রবল হবে। মাঝে মাঝে শিশুর চুল মুড়ে ফেলে দিয়ে তাতে ভৃঙ্গরাজের তৈল বা রস মালিস করলে চুল সুন্দর ও স্মৃতিশক্তি বর্ধিত হবে। শিশুর গায়ে সাবান না দিয়ে বিশুদ্ধ মুলতানী মাটি ও তিল বাটা দ্বারা শরীর মর্দন করে দিতে হবে। গামছা দ্বারা গা মোছাইয়া বেবী পাউডার লাগাতে হবে।
- শিশুর পোষাক স্বচ্ছ, সুন্দর, হালকা ও সুতীর হওয়া উচিত। কোন প্রকার টাইট পোশাক পরিধান করাণ উচিত নয়, প্রতিদিন দুই তিন বার কাপড় বদলে দিতে হবে এবং একবার ধোয়া পোষাক দুইবারের বেশী পরাবার প্রয়োজন নেই।
- রোজ সাবান কিম্বা সোডা দিয়ে কাপড় না ধুয়ে প্রতিদিন জলে ধুতে হবে এবং ২/৩ দিন পরে সাবান বা সোডা দিতে হবে।
- ৩/৪ মাস পরে পুরাতন পোশাক বাদ দিয়ে নূতন পোশাক ব্যবহার করাতে হবে।
- শিশুদের হেঁটে বেড়াবার সময় হলে তাকে একটু চলাফেরা করানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজন হলে তিন চাকার ঠেলা প্যারাম্বুলেটার তৈরী করে দিতে হবে তা ধরে শিশু চলতে শিখবে। চলাফেরা শরীর বৃদ্ধি হওয়া ও ভাল থাকার জন্য প্রয়োজন।
- আজকাল ৩/৪ বৎসর বয়স হলেই শিশুকে লেখাপড়া শিক্ষা দিবার ব্যবস্থা থাকা উচিত। তাতে শিশুর সময় কেটে যাবে এবং লেখাপড়ার অভ্যাস হবে।
- ৫ বৎসর হলে নিয়মিত স্কুলে পাঠানো উচিত কিন্তু তার যেটুকু ইচ্ছা তাকে ততটুকুই পড়তে দেওয়া উচিত। কারণ লেখাপড়া করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেও তাকে আদর করে কিছু সময় পাঠশালায় বসিয়ে রেখে পরে নিয়ে আসতে হবে তা না হলে তার মন বসবে না এবং স্বাস্থ্যের উপরে প্রভাব পড়বে। তার মনেরও আনন্দ নষ্ট হবে।
- ক্রমে ক্রমে পড়াশুনার সঙ্গে বালকের স্বাস্থ্যরক্ষার সাধারণ নিয়মগুলি, যেমন সময়মতো শয়ন করা, সময় মতো ওঠা, মুখ ধোয়া, প্রাতঃকালে খাওয়া, পড়তে বসা, খেলতে যাওয়া, স্নান করা ইত্যাদি।
- তার দৈনন্দিন ভোজন ও মলত্যাগের বিষয়ে মাতাপিতার খোঁজ নেওয়া প্রয়োজন। কারণ পায়খানা পরিষ্কার না হলে কৃমি ও কোষ্টবদ্ধতা হয়ে স্বাস্থ্যের হানি হতে পারে।
- কোন কারণে কম খেলে এবং বেশী খেলে শরীরের উপর তার প্রভাব পড়তে পারে, এই জন্য ৬/৭ বৎসর বয়স পর্যন্ত বালক বালিকাদের খাদ্যের একটি নির্দিষ্ট তালিকা ও সময়সূচি থাকবে। তাদের বাইরের খাদ্য খেতে দেওয়া উচিত নয়। সারাদিন কেবল খেলেই শরীর ভাল থাকে না।
প্রাচীন মত অনুসারে শিশুর যত্ন
“প্রাচীন মত অনুসারে শিশুদের রাসায়নিকও তড়িৎ প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য ভলো প্রবালশঙ্খ, সামুদ্রিক ঝিনুক, অষ্টধাতু, রুদ্রাক্ষ কৌড়ী, চন্দন ইত্যাদির মালা পরিধান করাতে হবে। ঐসব জিনিষে যে বৈদ্যুতিক শক্তি আছে তা শিশুদের শরীরের পক্ষে উপযোগী, বৈষ্ণবগণ যে তুলসীর মালা ধারণ করেন তাতে তাদের শরীরে তড়িৎ ক্রিয়া হয়ে থাকে এবং মন ও স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল ফল প্রদান করে। নবরত্ন ধারণ করাতে পারলে উত্তম।“
বাড়ন্ত শিশুদের সুন্দর স্বাস্থ্যের খাদ্য তালিকা:
কি খাবে, কতটা খাবে তা নির্ভর করবে কোথায় থাকেন, পরিবারের খাবার ধরন বা অভ্যেস, খাবারের স্বাদ, হজম করার ক্ষমতার ওপর।
- ৬ মাস পর্যন্ত যদি মায়ের দুধ খায়, তবে আর কোনো খাবারের দরকার হয় না।
- ৬ মাস পর কলা বাচ্চার হজম শক্তি চাহিদা অনুসারে সিকি ভাগ করে বাড়ান। একটা ডিম সেদ্ধ ; অংশ বা খুব সামান্য টাটকা মাছ। ডালের ভেজিটেবল স্যুপ ৫-৬ আউন্স সঙ্গে বেবিফুড।
- ৭ – ৯ মাস পর্যন্ত বাড়িতে তৈরী খাবার, যেমন—পাতলা সুজির পায়েস। ৫-৬ মাস পর্যন্ত পেপে সেদ্ধ, ডালের, ভেজিটেবল স্যুপ।
- ৬ মাসের পর আধা থেকে একটা ডিমসেদ্ধ, চিকেন স্টু। গরুর দুধ পাতলা কবে মিশিয়ে দিন।বাজারে পাস্তুরাইজড দুধও পাতলা করে দিতে পারেন। সাথে গলা ভাত, মাছ, শাকসবজি দেবেন।
- ৯ মাস-১বছরঃ
চিকেন, মটন শুরু করুন। পাতলা না করা সম্পূর্ণ দুধ, চিড়ে মুড়ি। দুধ না খেতে চাইলে ঐ পরিমাণ ছানা বা দই।
- ১-৩ বছরঃ সামান্য মশলাদার খাবার।
- ৩-৪ বছরঃ এই সময় বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে, তাই টিফিনে কলা বা পছন্দমতো ফল, বিস্কুট, কেক, টোস্ট, রুটি, লুচি বা পরোটা।
- ৫ বছরের পর ও বাড়ির সাধারণ খাবার।

